কিভাবে কাটছে কুবি শিক্ষার্থীদের করোনার দিনগুলো

স্বকৃত গালিব :

“একসাথে চল, পাশা পাশি চলি,এক সাথে বাঁচি”এই মন্ত্রকে ধারণ করা পৃথিবী আজ বলছে”চল দূরে দূরে থাকি,নিজে ভালো থাকি”।মানুষ থেকে মানুষকে পৃথক করে রাখছে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। এই ভাইরাসের প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবী।বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এই ভাইরাসের জন্য সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ দিয়েছে লাল মাটির পাহাড়ি ক্যাম্পাস । কবে খুলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এই সংকটকালীন মুহূর্তে কিভাবে কাটাচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা? তারই উত্তর পাঠকদের তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

মোহাম্মদ রাসেল মিঞা
আইন বিভাগ
এগারোতম ব্যাচ
সহসা পৃথিবীতে ধেয়ে আসা এক অলৌকিক কালো থাবায় থেমে গেছে পৃথিবীর সক্রিয়তা।অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া রুটিনকে ডিঙিয়ে সময় কাটছে এক বন্দী জগতের ঘোরে।ব্যস্ততায় জেগে থাকা পৃথিবী হারিয়েছে তার চিরচেনা জৌলুস। তবে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়ানোর আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধের ঘোষণা আসে তার পর থেকেই কোয়ারেন্টাইন নামক বন্দীশালায় দিন অতিবাহিত হচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে।ফজরে সৃষ্টিকর্তার সামীপ্যে সপে দেয়ার মাঝেই শুরু হয় সকাল।এলাকায় করোনা দুর্যোগকালীন সময়ে যুক্ত আছি একজন সেচ্ছাসেবক হিসেবে, এলাকার মানুষকে সচেতন করতে সাধ্যমত চেষ্টা করছি।

সারাদেশ প্রায় লক ডাউনে বন্দী হলেও মানুষের আহারের যোগানদাতা আমার কৃষক বাবা থেমে নেই,রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরো উদ্যোমে।বাবাকে কৃষি কাজে সহায়তা করার মধ্যে দিয়েই কিছু বেলা কেটে যায়।বাড়ির টুকটাক কাজও করছি আনন্দ নিয়ে।অবসরের সময়টা হেলায় না কাটিয়ে উত্তম রূপে পার করছি সেজন্য ইউটিউবে দেখছি অজানা অনেক পুরনো ইতিহাস,পড়ছি বিভিন্ন বই।ইসলামী অনেক বিষয় জানার চেষ্টা করছি,শেখা হয়নি এরকম বিষয়গুলো শিখছি।এত কিছুর পরও প্রিয় আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে সূর্যাস্তের রক্তিম আভায় মুহূর্তে স্বপ্ন দেখি এক নতুন প্রভাতের যেদিন এ পৃথিবী থেকে করোনা নামক ভয়ানক কালো থাবা বিদায় নিবে-পৃথিবী খুজে পাবে তার নিজস্ব গতিপথ।

রুদ্র ইকবাল
ইংরেজি বিভাগ
বারোতম ব্যাচ
এই লকডাউন কালীন সময়ে অনেকটা হতাশ জনক। মানুষ সামাজিক জীব কিংবা মানুষ স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করা প্রানী বাণী শুনে বড় হওয়া মানুষ গুলো নিজেকে হটাৎ বন্দি করে নেওয়াটা অনেকটা কষ্টসাধ্য। তবে এই গৃহবন্দিকালীন সময় গুলো মানুষকে বুঝাতে পারতেছে, কোন দোষ ছাড়াই চিড়িয়াখানা পশুপাখি গুলো বন্দী কষ্ট। তাদের কষ্ট গুলো অনেকটা মানুষ বুঝতেছে। এই লকডাউন প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলে ও, বাবা-মা, ছোট ভাই-বোনদের সাথে সময় দেওয়া, পাশাপাশি মা’কে ছোট কাজ গুলোতে সাহায্য করা এক স্বর্গীয় আনন্দ পাওয়া যায়। বই পড়া, স্রষ্টার সান্নিধ্যে লাভের জন্য ইবাদত, ইত্যাদি নিজেকে ভাল হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। তবে এটাই চাই যেন, এই ঘোর অমানিশা দ্রুত কেটে যাক, পৃথিবী ফিরে পাক নতুন জীবন।

ফেরদৌসী সুলতানা
ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
নবম ব্যাচ

গ্রীষ্মেকালে যখন চারিদিকে প্রচুর রৌদ্রতাপ বিরাজ করে তখন প্রত্যেকে এক পশলা বৃষ্টির আশা করে। যেনো প্রকৃতি আবার তার নিজের সতেজ রুপ ফিরে পায়। কিন্তু তাই বলে এটা নয় যে এক পশলা বৃষ্টির পরিবর্তে সেই বৃষ্টিই কাল রূপ ধারন করে প্রকৃতিকে ভাসিয়ে দেবে। তেমনি ছাত্রজীবনে পড়াশোনা, ক্যাম্পাস, টিউশনি আড্ডাবাজির মধ্যে ২/৪ দিনের ছুটে পাওয়া মানেই প্রিয়জনদের সাথে বাড়িতে ছুটে যাওয়া। ঠিক সেভাবেই বাড়িতে এসেছিলাম প্রিয়জনদের সাথে দেখা করতে। সাথে সাথেই দেশে আঘাত হানলো করোনার ভয়াবহ থাবা। সবাইকে সুরক্ষা ও নিরাপদ রাখার জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ হলো ১৫ দিনের জন্য। তারপর ভয়াল থাবায় করোনায় দেশের অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হতেই আছে।

প্রতিদিনেই বাড়ছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সাথে মৃত্যুর মিছিল। জানিনা এর শেষ কোথায়। কিন্তু এভাবে চিরচেনা সেই বিদ্যাপিঠ আর ভালোবাসায় রঙানো বন্ধু-বান্ধব, বড় ভাইবোন, ছোটভাইবোন, শিক্ষক-শিক্ষিকা চায়ের দোকানের আড্ডা সব কিছু আজ চরম ভাবে মিস করছি। যেখানে আমাদের বিচরণ ছিলো অবিরত। কিন্তু আজ ঘরে বসে এই সোনালী অতীত মনে করা ছাড়া আর কিছুই করার নাই আমাদের। আমাদের সমাজের মানুষের অসচেতনতার কারনে করোনা আরও ভয়াবহ রুপ ধারন করছে। প্রতিক্ষনেই একটা ভয় হৃদয়কে কুরে খায় আর তা হলো প্রিয়জনদের,সাথে আবার দেখা হবে কিনা! কিংবা প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আবার সবাইকে পাবো কিনা! আবার সেই রঙিন,উৎসব মুখর দিন ফিরে পাবো কিনা। বাড়িতে এইভাবে আর কতদিন থাকা যায় তবুও সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছি। এই কামনায় করি সারাক্ষণ পৃথিবী দ্রুত সুস্থ হোক। সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক।

জুবায়ের রহমান
নৃবিজ্ঞান বিভাগ
তেরোতম ব্যাচ
কয়েকটা দিনের জন্য ছুটি আমি নিজেও চেয়েছিলাম। কিন্তু এমন শ্বাসরুদ্ধকর ছুটি আমি কখনো চাইনি। এই ঝড় হয়ত থেমে যাবে।উঠবে নতুন সূর্য।কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসের দিনগুলোর কথা মনে হলেই মনে মনে পৈশাচিক ব্যথা অনুভব করি। কতই না মায়াভরা আমাদের লাল মাটির সবুজ ক্যাম্পাস। খুব খারাপ ভাবেই দিনগুলো মিস করছি। মিস করছি বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়র মধুর সম্পর্কগুলো। এখন সময় কাটে ইতিহাসের কিছু বই পড়ে। মাঝে মাঝে লেখালিখিও কিছু করছি। বিকেলে নাটাই-সুতোয় ঘুড়ি উড়িয়ে দিব্বি সময় পার করে দিচ্ছি। বাড়িতে থেকেও ভাইবোনদের কাছে পাচ্ছি না। না পেলেও অনলাইনে নিয়মিত তাদের খোঁজ নিতে পারছি। তবু ক্যাম্পাসের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করলেই হৃদয়ে রক্তহরণ হয়। ভালো থাকুক কুবি পরিবারের প্রতিটি সদস্য। করোনা পরবর্তী বিশ্বে আবার আমরা সবাই ফিরব এই লাল মাটির সবুজ ক্যাম্পাসে, সেই প্রত্যাশায়!

ইফরানা ইসরাত
আইন বিভাগ
চৌদ্দতম ব্যাচ
মানব সভ্যতা এক বিশাল সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ।এত খারাপ সময় একাবিংশ শতাব্দীর মানুষ আগে কখনো দেখেনি।এই খারাপ অবস্থার একমাত্র কারণ মরণঘাতি এক ভাইরাস।যে ভাইরাস মানুষের ফুসফুসকে তিলে তিলে অকেজো
করে দিয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।আর এই ভাইরাস যাদের যাদের দেহে প্রবেশ করতে পারেনি তাদের আক্রান্ত করেছে নিঃসঙ্গতার এক ছবলে।আজ আমরা বন্ধুদের থেকে অনেক দূরে।নেই বাস ধরার তারা,নেই ক্লাসের তারা,নেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া।এখন শুধুই একাকিত্ব।আর এই একাকিত্ব কিছুটা কমিয়েছে মায়ের রান্না বান্নায় সাহায্য করে,আর এর ফাঁকে মায়ের হাতের মজাদার রান্নার কৌষল ও শিখে নিচ্ছি।বাড়ির সবাই একসাথে বসে লুডু খেলতে খেলতে মায়ের হাতের মজার মুড়ি মাখানো নিঃসঙ্গকে কিছুটা হার মানিয়েছে।আর এরই ফাঁকে ফেসবুক ও ম্যাসেনঞ্জারে সবার খোঁজ খবর নিচ্ছি।আর অবসরের সময় গুলো স্রষ্টার সান্নিধ্যে লাভের জন্য ইবাদত, বই পড়ে,মুভি দেখে কাটছে সময়।আর বিকেল সময়ে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে, নিল আকাশে মুক্ত পাখি গুলোর দিকে তাকিয়ে, মুক্ত পৃথিবীর বুকে নিশ্বাস নেওয়ার স্বপ্নে নিজের নিঃসঙ্গ সময় গুলো ভুলিয়ে রাখছি।

জুনাইদ আল হাসান
ইংরেজি বিভাগ
দশম ব্যাচ
জনাকীর্ণ পৃথিবীতে আজ নিসঙ্গ মানুষ।
সঙ্গবদ্ধ হয়ে থাকাই যাদের স্বভাব আজ তারা নিসঙ্গতায় অভ্যস্ততা হবার তাড়ায় ব্যস্ত! সে সঙ্গপ্রিয় মানুষের আমিও একজন আজ বড্ড নিসঙ্গ। আজ আর নয়টার ক্লাস ধরার জন্যে আটটার বাস ধরার তাড়া নেই! সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনো ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত হলো কিনা তা নিয়ম করে সিআর আপডেট দেখার নিত্য অভ্যাসটা কেমন যেন অনভ্যাসে পরিনত হচ্ছে! কোনো ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত হলে নেই লাফালাফি হইহুলালোর করে হঠাৎ করেই ক্লাসের ফাঁকে শালবন শহীদমিনারে কিংবা কাঁঠালতলা আড্ডার জন্যে ছুটে যাবার তরজুর নেই।কাঁঠালতলা, বাবুই চত্তর, সাইন্স ও আর্টস ফ্যাকাল্টির মধ্যকার প্রেমসেতু হয়তো আমার মতোই নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ না পেয়ে গুঙ্গরে কাঁদছে! এক অদ্ভুত অদৃশ্য করোনা ভাইরাস! সব কিছু যেন আজ মৃত্যুপুরী।

প্রতিদিন সকাল বিকাল রাতে নিয়ম করে টিউশের ব্যস্ততা নেই। নেই ওয়াই ফাই সংযোগে রাত করে মুভি কিংবা নাটকে মুখ গুঁজে থাকা। নেই রাত করে বন্ধুদের সাথে চ্যাটিং। আজ করোনার অতঙ্কে আমরা আতঙ্কিত, জীবনকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আজ আমরা গৃহবন্দী। আর বন্ধুদের সাথে ভালো মন্দ খোজ রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে একমাত্র ভরসা। যা ব্যবহার করেই কাটছে এই দিনগুলো।আজ ত্রিজি ও ওয়াই ফাই বিহীন টু-জি জীবন। এ যেন নিত্য বিরিয়ানি পুলাউ কুর্মা খেয়ে বড় হওয়া রাজপুত্রের হঠাৎ আলুবর্তার হোস্টেলের অনভ্যস্ত খাবার। এই প্রথম আমি বিশ্ববিদ্যালয়েল একাডেমিক বইগুলো খুব মিস করতেছি। রাত ১২ টা কিংবা ১ টায় ঘুমানো আমি আজ রাত ১০টায় দিব্যি ঘুমাচ্ছি। আজ ছোট ছোট বাচ্ছাগুলো আমার সঙ্গী। ফোনটা ভালো করে ব্যবহার করতে পারছি না মায়ের বকনি শুধু এই একটা জিনিসেই।
আগে যখন পাঁচ থেকে ছয় দিনের জন্যে আসতাম তখন যে মধুর ব্যবহার করতো আজ দীর্ঘদিনে মনে হচ্ছে সেগুলোও অচেনা। ছোট ছোট ঠুনকো বিষয়ে প্রায়শই মায়ের লাল চোখ দেখতে পাচ্ছি। মেসেজ করেই বন্ধুর আবেগ ঘন কথা কবে আমরা আবার এক সাথে হবো রে! এটা শুনার পর কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি
তবোও শান্তনা খুঁজি হয়তো আবারও দেখা হবে লাল পাহাড়ের ক্যাম্পাসে। হবে আড্ডা কাঁঠালতলা, বাবুই চত্বর, শহীদি মিনার কিংবা প্রেমসেতুতে।এতো কিছুর পরও বলছি
তোমরা ভালো থেকো,
আমিও যেন ভালো থাকি
সেই কামনা করো।
আবারও যেন দেখা হয়
আবারও যেন গল্প হয়
আসবো আবার ফিরে
শহীদমিনার কাঁঠালতলার তীরে।

     আরো পড়ুন....

পুরাতন খবরঃ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
error: ধন্যবাদ!